নাম : আরব কন্যার আর্তনাদ
লেখক : এনায়েতুল্লাহ আলতামাস
অনুবাদ : শহিদুল ইসলাম
(একটি ঐতিহাসিক উপন্যাস)
ডাউনলোড
পাঠকের জন্য বইয়ের প্রথম থেকে কিছু অংশ দিলাম পড়েই দেখুন.......
৬৩০ খৃস্টাব্দের ৫ ফেব্রুয়ারি, ৮ হিজরী সনের ১৫ শাওয়াল। রাসূল সা.
তায়েফ অবরােধ করলেন। হুনাইন ও আউতাসে তুমুল লড়াই করে তায়েফ
পৌছে মুসলিম লস্কর। তায়েফ শহরকে অবরােধ করার প্রাক্কালে বেঈমানদের
আতঙ্ক আল্লাহর তরবারী নামে খ্যাত খালিদ বিন ওয়ালিদ মারাত্মকভাবে
আহত হলেন। খালিদের আঘাত খুবই মারাত্মক। জীবনের আশা নেই।
জীবন মৃত্যুর মুখােমুখী খালিদ। বীর বাহাদুর খালিদ শত্রু পক্ষের আঘাতে
অশ্বপৃষ্ঠ থেকে পড়ে গিয়ে সােজা হয়ে দাঁড়াতে পারছেন না। শত্রু বাহিনীর
অসংখ্য ধাবমান ঘােড়া তার ওপর দিয়ে চলে গেছে। এমতাবস্থায় খালিদ যে
জীবিত রয়ে গেছেন সেটিই ভাগ্যের ব্যাপার।
রাসূলের জীবনে এটি ছিল হক ও বাতিলের মধ্যে একটি যুগান্তকারী
লড়াই। আবু বকর, ওমর ও আব্বাস রা.-এর মতাে প্রথম সারির সকল
সাহাবীই লড়াইয়ে লিপ্ত। রাসূল সা.-এর নেতৃত্বে তায়েফ এলাকার অধিবাসী
বনী ছাকিফ ও হাওয়াযিন কবিলার মােকাবেলায় লিপ্ত। তায়েফ অঞ্চলে বনী
ছাকিফ ও হাওয়াযিন কবিলা যুদ্ধবাজ হিসাবে খ্যাত। মালিক বিন আউফ
নামে ত্রিশ বছরের এক যুবক মুসলিম বাহিনীর বিরুদ্ধে নেতৃত্ব দিচ্ছে। মাত্র
ত্রিশ বছর বয়সে এমন কঠিন লড়াইয়ে নেতৃত্বদানের কথা শুনতে অবাক
লাগলেও মালিক বিন আউফ এততা অল্প বয়সেই যুদ্ধবাজ কবিলা দুটির
সেনাপতিত্ব করার সময় যােগ্যতার অধিকারী। কবিলা দুটির মধ্যে মালিক
বিন আউফের কোন জুড়ি নেই। মালিক বিন আউফ কবিলা দুটির জন্য
বিস্ময়কর যুদ্ধ প্রতিভা, আশা ভরসা ও সকলের গর্ব। তরুণ মালিক বিন
আউফ, তার কৌশলী চালে হুনাইন ও আউতাসে মুসলিম বাহিনীকে
খালিদ বিন ওয়ালিদ জীবন মৃত্যুর মুখােমুখি। ক্ষতস্থান থেকে
মাত্রাতিরিক্ত রক্তক্ষরণের ফলে তাঁর শরীর অসাড় হয়ে পড়ে। রাসূল সা.
তাকে দেখে ক্ষতস্থানে ফু দিলেন। এতে খালিদ চোখ মেলে তাকালেন।
রাসূল সা.-এর বরকতময় স্পর্শে ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালেন খালিদ। এরপর
মারাত্মক আঘাত নিয়েই শেষ অবধি রণাঙ্গনে অবিচল থাকলেন তিনি।
তায়েফ অবরােধ ছিল এ যুদ্ধের শেষ ও চূড়ান্ত মহড়া। হুনাইনে রাসূলে
কারীমের নেতৃত্বে সাহাবায়ে কেরাম চরম আঘাত হানলে ছাকিফ ও হাওয়াযিন
গােত্র মুসলিম বাহিনীর আক্রমণে পিছু হঠতে বাধ্য হয়। পশ্চাদপসারণ করে
কবিলা দু'টি দুর্গসম তায়েফ শহরে গিয়ে আশ্রয় গ্রহণ করে। পশ্চাদপসারণ
করলেও তাদের মনোেবল এতােটুকু দুর্বল হয়নি। বরঞ্চ তারা ছিল
অপরাজিতের আত্মপ্রশংসায় উৎফুল্ল। দুর্গে আশ্রয় গ্রহণ করে মালিক বিন
আউফ ঘােষণা করল, “আমরা মুসলমানদের ভয়ে আশ্রয় নেইনি, বরং
মুসলমানদেরকে আমাদের ইচ্ছে মতাে যুদ্ধ করাতেই দুর্গে এসেছি।”
দীর্ঘ আঠারাে দিন অবরােধ বহাল রাখা হলাে। মুসলমানরা বিপুল
উৎসাহে দুর্গপ্রাচীর ডিঙ্গানাের জন্য আক্রমণ করতে গিয়ে শত্রুপক্ষের।
শরাঘাতে আহত ও নিহত হতে লাগল। অবরােধ শেষে রাসূল সা.
শীর্ষস্থানীয় সাহাবী আবু বকর, ওমর ও আব্বাস প্রমুখের সাথে পরামর্শ
বৈঠকে বসলেন। নেতৃস্থানীয় সাহাবায়ে কেরাম অবরােধ প্রত্যাহার করে
মদিনায় ফিরে যাওয়ার পরামর্শ দেন। কিন্তু অধিকাংশ সাহাবী ফিরে যাওয়ার
সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ করে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে প্রবল আগ্রহ প্রকাশ করলেন।
অধিকাংশ সাহাবী দুর্গপ্রাচীর ডিঙিয়ে দুর্গ জয় করার জন্য উদগ্রীব ছিলেন।
সাহাবায়ে কেরামের প্রবল আগ্রহে রাসূল সা. আর একবার দুর্গপ্রাচীর
ডিঙানাের অনুমতি দিলেন। অনুমতি পেয়ে সাহাবায়ে কেরাম দুর্গপ্রাচীরে
তীব্র আঘাত হানলেন। কিন্তু দুর্গপ্রাচীরের ওপর থেকে তীরবৃষ্টি নিক্ষেপ করা
হলাে। এতে বহু সংখ্যক সাহাবী আহত ও নিহত হলেন। তাদের পক্ষে আর
প্রাচীর ডিঙানাে সম্ভব হলাে না। বাধ্য হয়ে তাদের পিছু হটতে হলাে।
অবশেষে অবরােধ প্রত্যাহার করা হলাে। মুসলমানদের অধিকাংশ
যােদ্ধাই ছিলেন আহত। তাঁদের হতাহতের সংখ্যাও ছিল প্রচুর। অনেকেই
শাহাদত বরণ করেন। আহতদের অনেকেই ছিলেন চলাচলে অক্ষম। পঙ্গু
হয়ে পড়েছিলেন বহু সাহাবী। অধিকাংশ যােদ্ধা আহত থাকার কারণে দ্রুত
তবু গুটিয়ে প্রত্যাবর্তনের ব্যবস্থা করা তাদের পক্ষে সম্ভব হচ্ছিল না। তবু গােটাতে প্রয়ােজনের তুলনায় বেশী সময়ের প্রয়ােজন হয়ে পড়ে। তাছাড়া খুব বেশী আহতদের জন্য প্রয়ােজন ছিল নিরবচ্ছিন্ন বিশ্রাম। রাসূল সা. আহতদের বিশ্রাম ও চিকিৎসার জন্য দুর্গ এলাকা থেকে তাঁবু গুটিয়ে জি’রানায় পৌছে
তাঁবু ফেলেন।
মুসলমানরা ব্যর্থ হয়ে প্রত্যাবর্তন করছিলেন। তাঁদের প্রত্যাবর্তন শুধু
ব্যর্থতার গ্লানিই বহণ করছিল না, বিপুল সংখ্যক সহযােদ্ধাকে হারানাে ও
আহত হওয়ার যাতনাও তাদের মধ্যে সৃষ্টি করেছিল প্রচণ্ড মনােকষ্ট। তায়েফ
নগরী নিত্যদিনের মতােই অপরিবর্তিত ছিল, অজেয় দুর্গপ্রাচীরে যেন
মুসলমানদের ব্যর্থতায় উপহাস করছিল।
| কিন্তু প্রচণ্ড যাতনা, ব্যর্থতার গ্লানিকে ছাপিয়ে গেল আকস্মিক এক ঘটনা।
যেন অলৌকিক ঘটনার মতােই ঘটে গেল ব্যাপারটি। জিরানা থেকে
মুসলমানরা তখনও তাবু গুটিয়ে মদিনার দিকে রওয়ানা হননি, এমন সময় বনী
ছাকিফ কবিলার শীর্ষস্থানীয় ক’জন লােক মুসলমানদের শিবিরের দিকে এগিয়ে
এলাে। তারা শিবিরের কাছে পৌছে প্রহরীদের কাছে রাসূলুল্লাহ সা.-এর সাথে
সাক্ষাতের অনুমতি চাইলাে। তাদেরকে রাসূল সা.-এর কাছে নিয়ে গিয়ে
কয়েকজন শক্তিশালী সাহাবী নাঙ্গা তরবারী ও বর্শা নিয়ে সতর্ক প্রহরা দিতে
লাগলেন। কারণ প্রবল শত্রু পক্ষের এই লােকগুলােকে কোন অবস্থাতেই
মুসলমানরা নিরাপদ ভাবতে পারছিলেন না। কেননা, বেশ কয়েকটি অমুসলিম
গােত্র নবীজী সা.-কে হত্যা করার অব্যাহত চক্রান্ত করছিল। হাওয়াযিন
গােত্রের জন্য সমূহ বিপদ সৃষ্টি করেছিল মুসলমানদের হাতে বন্দি তাদের কিছু
সংখ্যক নারী ও শিশু। দুর্গ অবরােধের আগে এক যুদ্ধে ওদের পরাজয় ঘটে।
তাতে কিছু সংখ্যক হাওয়াযিন নারী ও শিশু মুসলমানদের হাতে বন্দি হয়।
তখনকার নীতিতে এরা ছিল যুদ্ধ বন্দি। পরাজয় কিংবা বিজয় অথবা সামরিক
চুক্তি ছাড়া তাদের পক্ষে মুসলমানদের হাতে বন্দি হওয়া নারী শিশুদের ফিরে
পাওয়ার কোন পথ ছিল না। এদিকে রাসূল সা, ঘােষণা করে দিলেন যুদ্ধে
পরাজিত হওয়ার পরও যদি শত্রু পক্ষের কোন ব্যক্তি ইসলাম গ্রহণ করে,
তাহলে তার সকল সম্পদ ফিরিয়ে দেয়া হবে।
| হাওয়াযিন গােত্রের আগত লােকদের মধ্য থেকে নেতৃস্থানীয় এক লােক
বলল “হে মুহাম্মদ! আমাদের কবিলার লােকসহ সবাই আপনাকে আল্লাহর
রাসূল হিসাবে মেনে নিয়েছে। আমাদের কবিলার সবাই আপনার ধর্মে দীক্ষা
নিয়েছে।”
আল্লাহর কসম! তােমরা কল্যাণের পথ অবলম্বন করেছ। এটাই “সীরাতে
মুস্তাকীম” বললেন রাসূল সা.।
কবিলার সর্দার বলল, “হে মুহাম্মদ! আপনি তাে আল্লাহর রাসূল! আপনি
কি আমাদের নারী শিশু ও সহায়-সম্পদ ফিরিয়ে দেবেন?”
| “আমাদের সাথে যুদ্ধ করে এবং আমাদের লােকজনকে হত্যা করে যে
সব জিনিস তােমরা হারিয়েছ, সেগুলাে ফিরে পাওয়ার কোন অধিকার
তােমাদের নেই” বললেন রাসূল সা.। তবে যে একক ও অদ্বিতীয় আল্লাহকে
তােমরা মহান প্রভু ও রব হিসাবে মেনে নিয়েছ, তার সম্মানে তােমাদের আমি
হতাশ করবাে না। তােমাদের কাছে নারী শিশু নাকি সহায়-সম্পদ বেশী প্রিয়?
“আপনি আমাদের নারী শিশুদের অন্তত ফিরিয়ে দিন।” বলল প্রতিনিধি
দলের নেতা।
রাসূল সা. হাওয়াযিন কবিলার নারী শিশুদেরকে মুক্ত করে দেয়ার নির্দেশ
দিলেন।
| হাওয়াযিন গােত্রের নেতাদের কাছে রাসূল সা.-এর এই উদারতা ছিল
আশাতীত। রাসূলের এই উদারতায় গােটা হাওয়াযিন গােত্রের লােক ইসলামে
দীক্ষা নিলাে।
এ ঘটনার দুই তিনদিন পর অজ্ঞাত পরিচয় এক ব্যক্তি মুসলমান শিবিরে
অনুপ্রবেশ করতে চাইলাে। লােকটির মাথা ও চেহারা ছিল কাপড়ে ঢাকা।
চোখ দু'টো ছাড়া তার কিছুই দেখা যাচ্ছিল না। নিরাপত্তারক্ষী সাহাবায়ে
কেরাম যখন তার প্রবেশ পথ আগলে দাঁড়ালেন, তখন সে নিজের পরিচয় না
বলেই রাসূল সা.-এর সাথে সাক্ষাতের আগ্রহ প্রকাশ করল।
“তুমি কি তায়েফ থেকে আসনি? জিজ্ঞেস করলেন একজন
নিরাপত্তারক্ষি
আপনার মুল্যবান মন্তব্য আমাদের সামনে আগানোর প্রেরণা যোগায়।