নাম : আন্দালুসিয়ার সমুদ্রসৈকতে
লেখক : এনায়েতুল্লাহ আলতামাস
অনুবাদ : মুহাম্মদ শফিউল আলম
তারেক বিন যিয়াদ কর্তৃক স্পেনের সমুদ্রসৈকতে রনতরী জ্বালিয়ে দেয়ার ঈমান দিপ্ত দাস্তান।
"আন্দালুসিয়ার সমুদ্রসৈকতে"
ডাউনলোড
বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম
৯৭ হিজরী মােতাবেক ৭১৫ খ্রিস্টাব্দের কথা। প্রতি বছরের মতাে এ বছরও হজ্জের মৌসুমে মক্কা শরীফে বিপুল সংখ্যক মানুষের সমাগম ঘটেছে। শহর ও শহরের আশপাশে, অলিগলিতে, রাস্তাঘাটে হাটবাজারে সর্বত্রই শুধু মানুষ, আরমানুষ । যেন সুদূর বিস্তৃত উপচে পড়া এক জনসমুদ্র।এই বিশাল জনসমুদ্রের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হল, তাঁদের সকলের লেবাস এক। ডান বগলের নিচ দিয়ে বাম কাঁধের উপর দিয়ে আড়াআড়িভাবে টাখনু পর্যন্ত নেমে আসা সফেদ চাদর। মুণ্ডানাে মাথা, আর নাঙ্গা পা'। তাঁদের সকলের দৃষ্টির লক্ষ্যস্থল, আর আশা-আকাংখার কেন্দ্রবিন্দু এক। তাঁদের অন্তর, আর অন্তরলােকের দীপাধার একমাত্র খানায়ে কা'বা।
তাঁদের লেবাস যেমন এক, তেমনি তাঁদের চিন্তা-চেতনা ও ধর্মবিশ্বাসও এক। তাঁদের মুখে 'লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহর' গুঞ্জন-ধ্বনি, আর বুকে ঈমান সংরক্ষণের শপথবাণী। তারা সকলেই হলেন হাজি। হজ্জ আদায়ের উদ্দেশ্যে একত্রিত হয়েছেন। গােটা মক্কা শহর ছােট বড় তাঁবুতে ভরে গেছে। তাঁবুতে ঘেরা এই ঘন বসতিপূর্ণ এলাকায় নারী-পুরুষ আছেন, ছােট ছােট ছেলে-মেয়েও আছে।
এই বিপুল জনসমুদ্রের লেবাস এক। কিন্তু গায়ের রং ভিন্ন। তাদের মাঝে গৌরবর্ণের মানুষ যেমন আছে, তেমনি চাঁদহীন অন্ধকার রাতের ন্যায় কালাে
চেহারার মানুষও আছে। বাদামী রং-এর মানুষ যেমন আছে, তেমনি গােলাপী চেহারার মানুষও আছে। আছে কমজোর ও দুর্বল মানুষ। সিপাহী আছে, আছেন সিপাহসালার। মনিব আছেন, আছে গােলামও।
মনে হচ্ছে, সকলেই যেন একই গােত্রের মানুষ। তাদের চাল-চলন এক। স্বরবে ও নীরবে তাঁরা এক। তাদের বাচনভঙ্গি এক। তারা কোন এক মুলুক থেকে আসেননি; এসেছেন বিভিন্ন মুলুক থেকে। তাদের মধ্যে কেউ এসেছেন আফ্রিকা থেকে, কেউ আবার চীন থেকে। কেউ এসেছেন ইরান থেকে, কেউ আবার তুরান থেকে। মােটকথা, যেখানেই ইসলামের নূর পৌছেছে, ঈমানের আলাে ফুটেছে সেখান থেকেই মুসলমানগণ হজ্জ উপলক্ষে মক্কা শরীফ চলে এসেছেন।
তারা একজন অন্যজনের ভাষা বুঝেন না, কিন্তু তাদের সকলের হৃদয় একই সুতার বাঁধনে বাঁধা। প্রত্যেকেই প্রত্যেককে হৃদয় দিয়ে অনুভব করছেন। একজনের আবাস-ভূমি অন্যজনের আবাস ভূমি থেকে যােজন যােজন মাইল দূর, কিন্তু তাদের হৃদয়-ভূমির মাঝে নেই কোন দূরত্ব। সকলের মাঝেই এমন সজ্জনভাব যে, কেউ কাউকে আজনবী মনে করেন না। মনে করেন না পরদেশী।
সফেদ এহরাম পরিহিত এই বিশাল জনসমুদ্রের সকলের অনুভূতিও সফেদ। তাদের অবচেতন মনের অনুভূতি হল—এটাই তাদের প্রিয় ভূমি। এটাই তাদের জীবন-সফরের আখেরী মনযিল। আস্থা ও বিশ্বাসের পবিত্র অনুভূতি তাদের
চেহারায় এক অভূতপূর্ব উজ্জল্য এনে দিয়েছে। মক্কা শরীফের আকাশে-বাতাসে মৃদুমন্দ ছন্দে সুরের ঝঙ্কার তুলে সকলের মুখ থেকে বের হয়ে আসছে :
“লাব্বাইক, আল্লাহুম্মা লাব্বাইক, লাব্বাইক লা-শারিকা লাকা লাব্বাইক,
ইন্নালহামদা ওয়াননে'মাতা লাকা ওয়ালমুল লা-শারিকা লাক্।"
মােহনীয় এই পবিত্র সুরের মূছনায় চতুর্দিকে এক নৈসর্গিক পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছে। রাজা-বাদশাহদের গর্ভিত মস্তকও বিনয়াবনত হয়ে পড়ছে। হৃদয়ের তন্ত্রিতে তন্ত্রিতে আল্লাহ প্রেমের ঝড় বয়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে ভাষা-বর্ণ, উঁচু-নীচুর বিভেদ ভুলে সকলেই যেন আল্লাহর রঙ্গে নিজেকে রাঙ্গিয়ে তুলছে। হজ্জের আনুষ্ঠানিকতা শুরু হতে এখনও কয়েকদিন বাকি। দূরদরাজ থেকে
এখনও হাজিগণ আসছেন। বিস্তৃত প্রান্তর জোড়ে তাঁবুর বসতি গড়ে উঠছে। দিন দিন উট আর দুম্বার আওয়াজ বেড়ে চলছে।
এই বিশাল জনসমুদ্রের মাঝে কিছু লােক ইতস্তত বিক্ষিপ্ত হয়ে বসে আছে। তাদের একটি হাত সামনের দিকে প্রসারিত। কেউ কেউ তাদের সামনে এক খণ্ড কাপড় বিছিয়ে রেখেছে। কারাে কারাে হাত কাপড়ের থলির মধ্যে। তারা সকলেই ভিখারী। তাদের কেউ কেউ আবার অঙ্গহীন। তারা সকলেই মরু বেদুইন।
হজ্জের দিনগুলােতে তারা মক্কা শরীফ চলে আসে। ভালাে আয়-রােজগার করে হজ্জ শেষ হলে চলে যায়। এই ভিখারিদের মাঝে একজন বৃদ্ধ ভিখারিও আছেন। এই ভিখারির মাঝে বিশেষ কোন বৈশিষ্ট্য নেই। অন্যান্য ভিখারির মতাে তাঁর লােবাসও ছিন্নভিন্ন। হাতে পায়ে ময়লা। চেহারা ধূলিধূসরিত। দাঁড়িতে লেগে থাকা বালুকণা রােদের
আলােতে চিকচিক করছে।
অন্যান্য ভিখারি ও তার মাঝে পার্থক্য শুধু এতটুকু যে, তিনি অত্যন্ত বৃদ্ধ ও কমজোর। বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকা তার পক্ষে সম্ভব হয় না। চোখে পড়ার মতাে আরেকটি বিষয়ও তাঁর আছে, যে কারণে লােকেরা তাঁর দিকে কিছুক্ষণ গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। তার পা বেড়ি দিয়ে বাঁধা। বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, তিনি একজন কয়েদি। বিশেষ অনুগ্রহে তাকে ভিক্ষাবৃত্তির অনুমতি দেয়া হয়েছে।
‘তুমি কয়েদি নাকি?' প্রথম দিনই একজন হাজি সাহেব তাকে জিজ্ঞেস করলেন। বৃদ্ধ সম্মতিসূচক মাথা উপরে নিচে করলেন। তার চোখের দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে এলাে। 'তুমি কি চুরি করেছ?” আরেকজন হাজি সাহেব জানতে চাইলেন।
‘চুরি করলে তাে আমার হাত কেটে দেওয়া হত। বৃদ্ধ তাঁর বলিষ্ঠ দু'টি বাহু সামনের দিকে প্রসারিত করে উত্তর দিলেন।
‘কোন মেয়েলােকের সাথে ধরা পড়েছিলে নাকি? অন্য আরেকজন হাজি সাহেব জিজ্ঞস করলেন।
‘তাহলে তাে আমি যিন্দা থাকতাম না। বৃদ্ধ কাঁপা কাঁপা আওয়াজে বললেন।
‘তাহলে তাে আমাকে পাথর ছুড়ে মেরে ফেলা হত। ‘তাহলে কী অন্যায় করেছ তুমি?'
প্রথমজন জানতে চাইলেন।
‘ভাগ্য আমার সাথে প্রতারণা করেছে।' বৃদ্ধ উত্তর দিলেন।
‘অপরাধীদের ভাগ্য এমনই প্রতারণা করে থাকে। দ্বিতীয়জন ফোড়ন কেটে
বললেন।
বৃদ্ধ ভিখারির দৃষ্টি মুহূর্তের জন্য জলসে উঠল। তিনি তাঁর আশ-পাশে দাঁড়ানাে লােকগুলাের দিকে উদাস চোখে তাকিয়ে রইলেন। ‘অপরাধী তার অপরাধের কথা কখনও স্বীকার করে না। তৃতীয়জন দার্শনিকের ন্যায় মন্তব্য করলেন। ‘আমার অপরাধ হল, খলীফা ওলিদ বিন আবদুল মালেক ইন্তেকাল করেছেন।' বৃদ্ধ ভিখারি বললেন। আর তার স্থানে তার ভাই সুলায়মান বিন আবদুল মালেক খলীফা নিযুক্ত হয়েছেন। দামেস্কের কয়েদখানায় গিয়ে দেখ, আমার মতাে বহু কয়েদি বিনা অপরাধে সেখানে শাস্তি ভােগ করছে।'
অন্য একজন হাজি বললেন, “তুমি কে? তােমার নাম কি? কোন কবিলার সাথে
তােমার সম্পর্ক? ‘আমার কোন নাম নেই। বৃদ্ধ ভিখারি বললেন। কেবলমাত্র আল্লাহ তা'আলার নামই অবশিষ্ট থাকবে।' তিনি আকাশের দিকে তাকিয়ে আবারাে বললেন। কেবলমাত্র আল্লাহর নামই অবশিষ্ট থাকবে...। যদি কিছু দাও তাহলে আল্লাহকে দেবে...। আল্লাহ তােমাদের হজ্জ কবুল করবেন। আমি আমার অপরাধের কথা বলতে পারব না। যদি বলি, তাহলে সেটাও আমার অপরাধ হবে। “ওয়া তুইজ্জু মান তাশাউ ওয়া তুযিল্লু মান তাশাউ...।” তিনি যাকে ইচ্ছা ইজ্জত
দান করেন, যাকে ইচ্ছা বেইজ্জত করেন...।
প্রিয় পাঠক! বাকিটা নাহয় বইয়ের ভিতরেই পড়ি!! ওকে নিচ থেকে ডাউনলোড করে নিন আর উপভোগ করুন.....
আপনার মুল্যবান মন্তব্য আমাদের সামনে আগানোর প্রেরণা যোগায়।